মৃত্তিকাদের মুক্তি

৯০ দশকের কথা, ল্যান্ডফোনের রং নাম্বার কলের মাধ্যমে পরিচয় হয় দেশ ও মৃত্তিকার একই ভার্সিটিতে পরার সুবাদে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব মোবাইল ফোন তখনো সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি এক সময় দুজনেই বুঝতে পারে তাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বের মাত্রা ছাড়াতে শুরু করছে কিন্তু কেউই প্রকাশ করতে পারছিলনা অতঃপর এল মোবাইলের দুনিয়া বন্ধুত্ব পেল অন্যএক মাত্রা দেশ তথাকথিত স্মার্ট ছেলে না হলেও তার বন্ধুভাবাপন্ন স্বভাব আর সাহায্যকারী মনোভাব সবার মনেই একটা স্থান করে নিয়েছিল আর মৃত্তিকা রুপের সাথে সাথে গুনেও পরিপুর্ন , সান্সকৃতি মনা তাই তাদের ভালবাসা অন্যের কাছে ইর্ষানিত্ব, কারো কারো কাছে নিখাদ সৌন্দর্যে প্রতীক হিসেবে পরিগনত হত
দেশ ও মৃত্তিকা অনেক বিষয়ে এক মত হলেও কিছু কিছু বিষয়ে দুজন দুমেরুতে অবস্থান করত তেমনি একটা বিষয় হল ক্যারিয়ার মধ্যবিত্ত জীবনের যাতাকলে পিষ্ঠহয়ে অনেক স্বপ্নকেই জলাঞ্জলি দেওয়া দেশ তার জীবিকার ব্যাপারে ছিল উচ্চাকাঙ্খী অন্যদিকে মৃত্তিকার চাওয়া পাওয়ার গন্ডি ছিল সীমিত ভালবাসার দেশকে আকরে ধরে স্বদেশের বুকে একটা সাজানো সংসারই ছিল তার স্বপ্ন জীবনের এ ক্ষুদপিপাশাই তাদের ভালবাসার কাল হয়ে দাড়াল
পড়াশোনা শেষ করে দেশ বৃত্তি নিয়ে পারি জমাতে চাইল দূর পাশ্চাত্যে, ভাল রেজাল্টের সুবাদে বৃত্তি পেয়েও গেল কিন্তু মৃত্তিকা চায়নি দেশ বিদেশে পাড়ি জমাক বড় হবার স্বপ্ন দেশকে তাড়িয়ে বেড়াত , তাই মৃত্তিকার টান অগ্রাহ্য করে দেশ দেশমৃত্তিকা ছেড়ে প্রবাসে খুটি গাড়ল দুর্নীতি, ঘুষে আছন্ন সমাজে, সহিংস রাজনীতির দেশে ভাল কিছু করা সম্ভব নয়- এ কথাটি দেশ প্রায়ই বলত মুলত সেই বিশ্বাস থেকেই তার প্রবাসে দেশী হবার শুপ্ত বাসনা
মা-বাবার একমাত্র সন্তান মৃত্তিকা বিশ্বাস করত দেশ প্রাচ্যের জীবনে দেশ হারিয়ে যাবে না মৃত্তিকার প্রেম তাকে ঠিকেই টেনে নিয়ে আসবে দেশও চিন্তা করত  উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে ফিরে আসবে  দেশমাতৃকার বুকে, মৃত্তিকার কাছে আবার তারা হাটবে শরতের শিউলি ভেজা ঘাসের পথ মারিয়ে, আইলের পাশের কাশফুল তাদের ভালবাসার আনন্দে দুলবে বৃষ্টিভেজা বর্ষায় কদম কেয়ারা এনে দেবে নতুন মাত্রা ফিরে আসবে দেশ মৃত্তিকার কোলে, বসন্তের কোকিলের মত নয়; ভোরের সূর্য হয়ে
প্রাচ্যের জীবনে দেশকে মানিয়ে নিয়ে অনেক কষ্ট হত, সেই সকল কষ্টের কথা মৃত্তিকার বুকের শতগুন হয়ে আঘাত করত মৃত্তিকা নিজেকে দেশের আনন্দ উল্লাশ থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখত এই ভেবে যে দেশ তো দূর প্রাচ্যে আনন্দ থেকে বঞ্ছিত হচ্ছে আস্তে আস্তে দেশ বিদেশ বিভূয়ে জীবনের সাথে মানিয়ে নিল পড়াশোনা, চাকরি সব মিলিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল দেশ আর তাতে করে দেশ-মৃত্তিকার প্রেমে ব্যবধান স্মৃষ্টি হতে থাকল  যদিও ব্যস্ততার জন্য দেশের কাছে বিষয়টা ততটা  অনূভত হতনা, কিন্তু মৃত্তিকা নিজেকে সামলাতে পারত না বিদেশে স্থায়ী হবার পরিকল্পনা শুনে মৃত্তিকার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পরল ইচ্ছাগুলো –
ক্ষত বিক্ষত মৃত আশার মত
অমানিশার অন্ধকারের মধ্যদিয়ে
দারিয়েছে এসে নিঃশব্দে
অন্তর্জলা স্বপ্নের কবরের কাছে।

এক সময় দুজনের যোগাযোগ বিচ্ছন্ন হবার উপক্রম হল তার তখনই ঘটল মৃত্তিকার জীবনের সবচেয়ে বড় দূর্ঘটনা সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্তিকার মা-বাবা দুজনেই হাসপাতালে অনেক চেষ্টা করেও বাচানো গেল না সান্তনা দেবার জন্যও কাউকে পাশে পেলনা মৃত্তিকা সব হারিয়ে সে যেন পাগলপ্রায়, উদাসী
একদিন পার্কে বসে ছিন্নমূল শিশুদের কষ্ট দেখে তাদের কথা শুনে মৃত্তিকা বুঝতে পারল তার মত আরো অনেক মৃত্তিকারাই আছে যাদের অবস্থা তার চেয়েও শোচনীয়   সমস্ত হতাশা ভুলে, কষ্টকে চেপে রেখে নতুন জীবনের পথচলা শুরু করল তবে সে এক ভিন্ন জীবন সব হারিয়ে মৃত্তিকা সবহারানোদের জন্য কাজ করতে নিজেকে বিলিয়ে দিতে মনস্থ করল শুরু হল ছিন্নমূল শিশুদের নিয়ে মৃত্তিকার নতুন যুদ্ধ সে যুদ্ধে সহযোদ্ধা সে নিজেই অনেক ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়েমৃত্তিকাদের মুক্তিসংঘঠনটি এগিয়ে যেতে থাকল যদিও মেয়ে শিশুদের নিয়েই পথ চলা , আস্তে আস্তে ব্যাপকতা বাড়ল কিছু কিছু এনজিও মৃত্তিকার এ মহতি উদ্দোগে এগিয়ে আসল মনে তার বেজে ওঠল জাগয়ানি গান
ওই যে
দূরের আলো যেখানে কুন্ডলিকৃত
ধোয়া পদচিহ্ন মুছে ফেলে
তুমি এগিয়ে যাও সেখানে
সঙ্গী লাগে না প্রকৃত বীরের

এভাবেই কেটে গেল ১০ টি বছর এর মাঝে দেশ-মৃত্তিকার যোগাযোগ চিরবিচ্ছিন্নব্যাক টু দ্যা রুটনামে একটি বিদেশি সংস্থা গবেষনার কাজে সাহায্যের জন্য মৃত্তিকার সাহায্য চাইলে মৃত্তিকা সম্মতি দিল সে মতেই তাদের প্রতিনিধিমৃত্তিকাদের মুক্তিঅফিসে আসার রাস্তা জানার জন্য ফোন করল, কন্ঠটা অনেক পরিচিত প্রতিনিধিকে দেখে মৃত্তিকা কিছুটা স্তম্ভিত, অনেকটা অস্বস্থিতে ভুগছে নুতুন পৃথিবী ছেড়ে দেশান্তরীত দেশ আজ স্বদেশে হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলো থেকে থেকে মাথায় জানান দিয়ে যাচ্ছে অন্যরকম জীবন হবার কথা ছিল, স্বপ্নগুলো অন্যভাবে দেখার কথা ছিল আজ সবই অতীত
মৃত্তিকা নিজেকে সামনে নিল মৃত্তিকার চেয়েও বেশি অস্বস্থিতে দেশ কি বলবে কিছুই বুঝে ওঠতে পারছে না মৃত্তিকা পেশাগত বাচনভঙ্গিদিয়ে ফেলে যাওয়া অতীতকে ঢেকে দিল স্বদেশে এসে বন্ধুর কাছে মৃত্তিকার সব কথা শুনে দেশের নিজের প্রতি অনেক রাগ হয় মৃত্তিকার কষ্টের দিনগুলোতে তার পাশে না দাড়ানোর কষ্ট দেশের ভেতরটাকে দুমরে মুচড়ে দিচ্ছে নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছিলনা দেশ প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর সে সবচেয়ে বেশি খুজেছে মৃত্তিকাকেই কিন্তু মৃত্তিকার কোন খোজই পায়নি দেশ
হঠাৎ মৃত্তিকার সব কিছুই কেমন বদলে যাওয়া মনে হচ্ছে । পৃথিবীর যা কিছু- সব সুন্দর হয়ে গেছে জ্বোনাকির। ঘুম থেকে ওঠা জ্বোনাকির সূর্য দেখা হয়নি অনেক্কাল। সোনালী আভা ছড়িয়ে ওঠা সূর্যকে সম্ভাষণ জানায় আজ সে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে।এতদিন যে নির্ঘুম রাত ছিল বিভীষিকার মতন, সেই রাত পার হয়ে গেল স্বপ্নে স্বপ্নে! কালো হা নিয়ে দুঃস্বপ্নের অজগর তাড়া করে আর আসেনি আগের মত।
একটি মুখ- যাকে বাস্তবে দেখবার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষার অসীম প্রহর গুনে গুনে ক্লান্ত হয়েছে সে, আজ সেই মুখ ভাসে চোখের পর্দায়, নিরন্তর।
কাজের পাশাপাশি দেশ তার বিদেশে জীবনের সমস্যার কথা গুলো মৃত্তিকার কাছে প্রকাশ করল আগের মত তাদের মত বন্ধুত্বের সম্পর্ক সৃষ্টি হতে থাকল দেশে মৃত্তিকা ঘুমন্ত প্রেম জেগে ওঠল কিন্তু মৃত্তিকা তার সে প্রেমে আর ফিরে না তাকানোর বৃথা চেষ্টা করে গেল একটা সময় পর মৃত্তিকাও দেশের প্রতি নতুন করে মোহবিষ্ট হল
বাদ সাধল নিয়তি যেদিন দেশ মৃত্তিকাকে আবার তার জীবনে ফিরে আসার কথা জানাবে তার আগের রেত্রেই একটা ইমেল তার নতুন করে দেখা স্বপ্নগুলো জাল বোনার আগেই ছিন্ন করে দিল ব্রেন ক্যান্সারের শেষ স্তরে দেশ ক্যান্সারে জর্জতির দেশ কিছুতেই নিজেকে আর মৃত্তিকার সাথে জড়াতে চায়নি জীবিনের শেষ দিনগুলোতে সে চেয়েছিল তার নিজের অস্তিত্বকে ফিরে পেতেতবে মৃত্তিকার সাথে দেখা হবার পর বারংবারই সে মনে মনে বলত প্রভু আর কিছুটা সময় দাও আমাকে নিতান্ত আপন করে, বিষাদমাখা কষ্টের স্মৃতিগুলো উদ্গিরিত করতে। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া শোষন, নিপিড়ন আর বর্বরতার ভরে তলিয়ে যাওয়া নিদারুন প্রেমটাকে আলো দেখাতে, বিদ্রোহী প্রেমিকা আমি শেষ নিশ্বাসে ঢেঊ তুলে, এক বিন্দু সময় প্রমান করব আমার প্রেমে খাদ ছিল না। আমি শুধুই পরিস্থিতির স্বীকার।  অশান্ত মনকে সময় বলে বলে যায় –
যে পথ মাড়িয়ে  এসেছ
সে পথে  আর তাকিয়ও না
ওপথে তোমাদের ভালবাসারা
বিষাদ কাব্যের পঙক্তি ছড়াচ্ছে


যুগেযুগে মৃত্তিকারা এভাবেই দেশপ্রেমে আবিষ্ট থাকে কিন্তু তাদের মুক্তি মেলে না কখোনই আমাদের চারপাশে এমন অনেক মৃত্তিকাদেরই দেখা মিলে যারা তাদের দেশে রুপি রুপকের জন্য নিজের অস্তিত্বকে চিরতরে বিলীন করে দেয় নিজেকে উজাড় করে দিয়ে একসময় ঠিকই বুঝতে পারে সে আধারে বন্দিনী অনেকে ইচ্ছায় আবার অনেকে অনিচ্ছায় নিজের সে বন্দীত্বকেই মৃত্তিকাদের মুক্তি বলে মেনে নেয় আর দেশ’রা – ওদের কথা নাই বা বলা হল। বলার মত তেমন কিছুই তাদের থাকে না।

(গল্পটি প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয় ১৯/১১/২০১৪ এ)

No comments

Theme images by merrymoonmary. Powered by Blogger.